সাগরদ্বীপ
সাগরদ্বীপ গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত একটি ব-দ্বীপ । এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকেরও পূর্বে। এই অনুমান প্রত্নতাত্ত্বিকদের। সাগরদ্বীপে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক ভাস্কর্য সেগুলির প্রমান। বর্তমানে যে জনসাধারণ ওই দ্বীপে বাস করে তারা অবশ্য খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের মূল বাসিন্দাদের উত্তর পুরুষ নয়। প্রাকৃতিক তান্ডব সাগরদ্বীপকে বহুবার জনশূন্য করে। সমুদ্রের করাল গ্রাস তাকে বার বার বিপদে ফেলেছে। পোর্তুগীজ ও মারাঠার মতো রাজনৈতিক দস্যুদের আক্রমনেও দ্বীপটি শ্মশানে পরিণত হয় অনেকবার। ক্রমে জঙ্গলাকীর্ণ শ্বাপদ সঙ্কুল বাঘ ও কুমীরের ভরা দ্বীপটি দুর্গম হয়ে ওঠে সভ্য জগতের কাছে।
কিন্তু ময়নাদ্বীপেও মানুষ বাস করে। জীবনের কঠিন বাস্তবে- নিরুপায় হয়েই। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যনিষ্ঠ চোখ নিছক কল্পনা বিলাসের জন্য নয়। তিনি জানতেন, বাস্তবের হোসেন মিঞাদের এরকম বহু ময়নাদ্বীপে কতনা কান্না লুকিয়ে আছে! তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ সাগরদ্বীপ। নাছোড় মানুষ এখানেও বসবাসের শুরু করে- একপ্রকার বাধ্য হয়েই। মেদিনীপুরের জমিদারেরাই এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখান বেশি। তারা ইংরেজ শাসকদের সাহায্যে এই দ্বীপটিকে তদের কলোনিতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেন। পামার ও বিউমন্ট সাহেবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা এ কাজে অগ্রসর হন।
সূচনাপর্বে তাঁরা জঙ্গল কেটে ভূমি তৈরি করেন। মেদিনীপুর থেকে কিছু মানুষ নিয়ে আসেন। ক্রমে জমিদারের জমি তৈরি করতে করতে সেই মানুষেরাও দ্বীপটিকে ভালোবেসে ফেলেন, এবং এখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখেন। ব্যক্তিগত জমির মালিকানা না পেলেও জমিদারের অধীনেই চাষ আবাদেই তারা খুশি। খুশি না হয়ে উপায়ই’বা কী! অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মানুষরা’তো ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মিঞার ময়নাদ্বীপে বাস করা মানুষদের মতোই। তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে এরা বিতাড়িত। দারিদ্র্যপূর্ণ অবস্থায় যাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান’ই জীবনের একমাত্র চাহিদা- তাদের কাছে সাগরদ্বীপ তো জঙ্গলের স্বর্গ। জমিদারদের মধ্যে দু’একজন অবশ্য দ্বীপটিকে ভালোবেসেই নিজেরা বসবাস শুরু করেন।
প্রথমে অখন্ড মেদিনীপুর জেলার আওতায় এটি থাকলেও পরে যোগাযোগ ও নৈকট্যের কারণে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮১১-১৪ সুন্দবনের জরিপ শুরু হয়। ১৮২২-২৩ নাগাদ মরিসন এই কাজ সুচারু রুপে সম্পন্ন করেন । যমুনা থেকে হুগলী পর্যন্ত
নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে তিনি কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে দেন। এই ভাগগুলিকে তিনি চিহ্নিত করেন ‘লট’(lot) হিসেবে। এই ‘লট’এর আঞ্চলিক রূপ ‘লাট’। সূচনা পর্বে এই লাট গুলির ইজারা পায় মেদিনীপুরের উৎসাহী কিছু জমিদার’রা। তাই তাদের বলা হয় ‘লাটদার’ বা ব্যাঙ্গে ‘লাটসাহেব’। এদের অধীনস্থ প্রজারা পরিচিত ছিল ‘লেটো’ বা ‘লাটুয়া’ নামে।
যদিও আজ আর সেই লাটদার নেই। বিশুদ্ধ ‘লেটো’র অস্তিত্বও সঙ্কটের মুখে। এখানে আজ শুধু মেদিনীপুর নয়- বহু জায়গার মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। হুগলী, হাওড়া, ডায়মন্ডহারবার, কাকদ্বীপ থেকে এসে কিছু মানুষ বাস করতে থাকে। এই ধারা আজও অব্যাহত।
CONTACT : sagardwip.wb@gmail.com