“…আমাদের জন্য নয়, আমরা তো ব্রাত্য নরনারী,
খিদেয় গর্জন করি, অন্ন পেলে চেটেপুটে খাই…”
একদল দামাল ছেলে, জীবন তাদের অনুষ্টুপ ছন্দে বাঁধা। কেউ গান গায়, কেউ ছন্দ ছড়ায়, ফুল-পাতা-আকাশ-মাটি নিংড়ে কেউ আবার রং-এর মেলা বসায়। কেউ স্কুল কেউ কলেজে পড়ে। আর সারাদিনের যুধ্যমান জীবনের ভিতরে যে নিঃশ্বাসগুলি হারিয়ে যেত, তাদের খুঁজে পাওয়ার জন্য গান-সাহিত্য-আবৃত্তি সর্বস্ব অনিয়মিত সৃজনশীল আড্ডা। একদিন এই কোকিলের বাসায় আলো পড়ল সূর্যের। কাঁচা মাটির গন্ধ ছড়ানো এক পত্রিকার জন্ম হল। শুরুর সে দিন ছিল অনেক তারার আলোয় ভেজা। দুনিয়া জয়ের কর্মশালা আর রুদ্ধসংগীতের এই মুক্তি-মঞ্চের বার্তাবাহক, “কৈশোরক” এর পথচলা সেই ১৯৯৬ থেকে আজও অব্যাহত। অপত্য শৈশব-এর ব্যথা আর ব্রাত্য কৈশোর-এর মর্মকথা প্রকাশের জন্য আমাদের এই সাজানো খেলাগাড়ি।
এতোদিন ধরে আমরা যা যা করতে চেষ্টা করেছি:
শুরুটাই হয়েছিল পত্রিকা দিয়ে। আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু কিশোর মনের ভাব-অনুভূতির প্রথম লিখিত প্রকাশ। তারপর থেকে এই পত্রিকার প্রকাশ আজও অব্যাহত। যদিও পরবর্তী সময়ে "কৈশোরক" পত্রিকা "সবুজপাতা" নামে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
বার্ষিক শিল্প প্রদর্শনী শুরু ৯৬ সাল থেকে। এলাকার শিশু শিল্পী ও উদীয়মান বা নামী শিল্পীদের চিত্র-ভাস্কর্য-আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়ে চলেছে। আনন্দের বিষয়- এই মফসসলেও আমরা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শিল্পরসিক দর্শক তৈরী করতে পেরেছি, আর তাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এছাড়াও গত বেশ কয়েক বছর ধরে লোকশিল্প ও হস্তশিল্প-ও প্রাধান্য পাচ্ছে এই প্রদর্শনীতে। মেদিনীপুরের পট, বর্ধমানের ডোকরা, মালদহের বাঁশশিল্প ও হস্তশিল্প-র বিশাল সম্ভারও থাকছে প্রদর্শনীতে। এ পর্যন্ত আমরা ৬০০-র ও বেশি শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত করতে পেরেছি।
সাহিত্য আড্ডা- অঞ্চলের স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে প্রথমে মাঠে-ঘাটে, পরে চার দেওয়ালের মধ্যে, তাদেরই লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ ও তা নিয়ে আলোচনা। শুরু থেকেই এই আড্ডা চলে আসছে আজও।
কর্মশালা- প্রত্যেক বছর বার্ষিক শিল্প প্রদর্শনীর আগে অনুষ্ঠিত হয় অঙ্কন কর্মশালা। নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ ও অলোক মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে বেশ কয়েকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে শিশুদের জন্য নাট্য কর্মশালা। এছাড়াও সারা বছর ধরে শুভঙ্কর দাশশর্মা-র দায়িত্বে চলছে শিশুনাট্য প্রযোজনার কাজ। ইতিমধ্যেই কৈশোরক প্রযোজনা করেছে দুটি নাটক- লন্ডভন্ড নোবেল কান্ড ও জুতা আবিস্কার।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশ চেনা, বিভিন্ন শিক্ষামূলক-মজার বিষয় নিয়ে স্থিরচিত্র প্রদর্শনী এবং প্রকৃতি পাঠের আসর।
বিভিন্ন স্কুলে "কৈশোরক" পরিচালিত দেওয়াল পত্রিকার কর্মসূচী বহুদিনের। বহু অজানা-অচেনা বন্ধুদের সবার সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় অনেক প্রস্তুতির পর কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই যার বেশ কয়েকটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে।
কিশোর মনের ভাবনা-চিন্তা আরো সুদৃঢ় করতে, অঞ্চলের প্রায় ২০ টি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে আন্তর্বিদ্যালয় বিতর্কসভা।
পুনশ্চ:
দেখতে দেখতে 'কৈশোরক' ২০ বছরে পা দিল। ২০ বছর একটা মানুষের জীবনে দীর্ঘ সময়। কিন্তু সংগঠনের ক্ষেত্রে তেমন মৌলিক কোনো হেরফের হয়নি। ২০ বছর আগে যে আশা, আকাঙ্খা ও স্বপ্ন থেকে শুরু হয়েছিল 'কৈশোরক'-এর যাত্রা, আজও তা আগের মতোই অব্যাহত। সাধ আর সাধ্যের যে ব্যবধান সেদিন আমাদের কাজকে ব্যাহত করতো, আজও তার কোনো তারতম্য নেই। হয়তো পত্রিকার মান কিছুটা বেড়েছে, বন্ধু বেড়েছে, কর্মী বেড়েছে এমনকি কাজের ক্ষেত্রও আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু সব কাজ সুসম্পন্নভাবে আজও উঠে আসছে না। সংগঠন নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে, আশা-আকাঙ্খার ক্ষেত্রে আমাদের আবেগ যতোটা আছে, কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেই পেশাদারিত্ব আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। এছাড়া যেমন পত্রিকার বিষয়ে বলা যায়- যাঁরা লেখাপত্র দেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত লেখেন না। যাঁরা অর্থানুদান করেন, তাঁদের সংযোগও নিয়মিত পাওয়া যায় না।
পাশাপাশি, গত ২০ বছরে কিশোর সম্বন্ধীয় সমস্যা কিশোর-কিশোরীদের থেকে অভিভাবকদের বেড়েছে শতগুণ। নিজেদের চাহিদামতো ছোটোদের টেনে-হিঁচড়ে বড়ো করার অদম্য বাসনায় কিশোর প্রাণ যায় যায়। কৈশোর কাল এখন বড়োদের রুটিন মাফিক ছাঁটকাট হয়ে চলেছে। এছাড়াও চারপাশে জুড়ে রয়েছে ঋজু-স্বতন্ত্র-সংস্কৃতিচর্চা ধ্বংস করার রকমারি-সূক্ষ্ম-ভদ্রস্থ আয়োজন। এই সব হাজারো সমস্যা নিয়েই....
আমরা শুরু করেছিলাম.... আমরা আছি.... আমরা থাকবো....